প্রত্যয়ন পত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ লিখিত দাপ্তরিক নথি যা কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি বা শিক্ষার্থীর বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রদান করে। এটি এক ধরনের অফিসিয়াল সার্টিফিকেট যা নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। যেমন: চাকরির আবেদন, পাসপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়া, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, ভিসা প্রসেসিং, বা উচ্চশিক্ষায় আবেদন ইত্যাদি।
এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো কিভাবে একটি নির্ভুল এবং প্রফেশনাল প্রত্যয়ন পত্র লেখা যায়।
প্রত্যয়ন পত্র কি?
প্রত্যয়ন পত্র এমন একটি লিখিত চিঠি বা দলিল যা প্রমাণ করে – একজন ব্যাক্তি
- কোথাও কাজ করেছে বা করছে
- কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়েছে বা পড়ছে
- তার আচরণ, উপস্থিতি বা দক্ষতা কেমন ছিল
- সে কোনো কাজে যোগ্য কি না
- সে কোনো অপরাধের সাথে জরিত কি না। ইত্যাদি
প্রত্যয়ন পত্র কেন লাগে?
বিভিন্ন কারনে বা প্রয়জনে এই পত্র লাগে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোঃ
- স্কুল/কলেজে ভর্তি হতেঃ পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানে আপনি সত্যিই পড়েছেন কি না, তা প্রমাণ করতে।
- চাকরির জন্য আবেদন করতেঃ আগে কোথায় কাজ করেছেন, সেটা প্রমাণ করার জন্য।
- ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতেঃ চাকরি বা ঠিকানা প্রমাণ করার জন্য ব্যাংক চায় অফিস থেকে প্রত্যয়ন পত্র।
- পাসপোর্ট বানাতেঃ অফিস বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একটি অফিসিয়াল পরিচয় দরকার হয়।
- ভিসা আবেদন করতেঃ আপনি কোথায় কাজ করেন, তা প্রমাণ করার জন্য দূতাবাস পত্রটি চায়।
- বাসা ভাড়া নিতেঃ অনেক বাড়িওয়ালা অফিসের বা পরিচয়ের কাগজ হিসেবে এটি চান।
- ইনকাম ট্যাক্স বা সরকারি কাজেঃ চাকরি বা আয় সম্পর্কিত প্রমাণ হিসেবে উক্ত পত্র লাগে।
- ছুটির দরখাস্তে সংযুক্ত করতেঃ অফিস থেকে ছুটির প্রমাণ দিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়।
- ছাত্র ছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন স্কলারশিপে আবেদন করতেঃ অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী হিসেবে প্রমাণ দিতে হয়।
- বিভিন্ন অফিসিয়াল আইডি বা পরিচয়পত্র করতেঃ যেমন: এনআইডি সংশোধন, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ইত্যাদি কাজে পরিচয় নিশ্চয়তার জন্য।
সহজ ভাবে বলতে গেলেঃ “যেখানে নিজের পরিচয়, পড়াশোনা বা চাকরির সত্যতা প্রমাণ করতে হয়—সেখানে প্রত্যয়ন পত্র দরকার হয়।”
প্রত্যয়ন পত্র কোথায় পাবো?
আপনার উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গা থেকে পত্রটি নিতে হয়। নিচে এর তালিকা গুলো দেওয়া হলোঃ
১. 🏫 স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
- হেড স্যার / অধ্যক্ষ / রেজিস্ট্রার অফিস থেকে
- শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয়, ভর্তি বা স্কলারশিপের জন্য
২. 🏢 অফিস বা কোম্পানি থেকে
- এইচআর (HR) বিভাগ / ম্যানেজার / সুপারভাইজারে কাছ থেকে
- চাকরি, অভিজ্ঞতা, বেতন বা ভিসার প্রয়োজনে
৩. 🏘️ ইউনিয়ন পরিষদ / পৌরসভা / সিটি কর্পোরেশন থেকে
- চেয়ারম্যান / মেম্বার / ওয়ার্ড কমিশনারের কাছ থেকে
- ঠিকানা, পরিচয় বা নাগরিকতা যাচাইয়ের জন্য
৪. 🏛️ সরকারি / আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে
- সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা / প্রকল্প পরিচালকের কাছ থেকে
- প্রশিক্ষণ বা সরকারি প্রকল্পে অংশগ্রহণের প্রমাণের জন্য
৫. 🏥 হাসপাতাল বা ক্লিনিক (বিশেষ ক্ষেত্রে)
- ডাক্তার বা কর্তৃপক্ষ থেকে
- চিকিৎসা সনদ বা মেডিকেল ফিটনেস যাচাইয়ের জন্য (যদি “সার্টিফিকেট” টাইপ হয়)
৬. 🏦 ব্যাংক (যদি নিজের অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে অন্যকে জানাতে হয়)
- শাখা ব্যবস্থাপকের থেকে
- ব্যাংক থেকে অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত প্রত্যয়ন (কিছু ক্ষেত্রে)

প্রত্যয়ন পত্র লেখার নিয়ম
প্রত্যয়ন পত্র লেখার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম মেনে চলা জরুরি, যাতে এটি প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রফেশনাল হয়।
১. প্রেরকের তথ্য
পত্রের উপরে থাকতে হবে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর ও ইমেইল আইডি (যদি থাকে)। অফিসিয়াল হেডেড প্যাডে লেখাই উত্তম।
২. তারিখ
প্রত্যয়ন পত্রে অবশ্যই নির্দিষ্ট দিনের তারিখ থাকতে হবে।
৩. প্রাপক
যদি নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়, তবে তার নাম ও পদবী উল্লেখ করতে হবে। না থাকলে “To Whom It May Concern” ব্যবহার করা যায়।
৪. বিষয় (Subject)
বিষয়: প্রত্যয়ন পত্র — সংক্ষেপে পত্রের উদ্দেশ্য প্রকাশ পায়।
৫. মূল বক্তব্য
মূল অংশে থাকা উচিত:
- ব্যক্তির নাম
- পিতার নাম (যদি প্রয়োজন হয়)
- পরিচয় (কর্মচারী/ছাত্র/ছাত্রী/অন্যান্য)
- কোথায়, কতদিন কর্মরত ছিলেন বা পড়াশোনা করেছেন
- কোন উদ্দেশ্যে এই প্রত্যয়ন পত্র দেওয়া হচ্ছে
৬. সত্যতা ও দায়িত্ব
শেষের অংশে একটি স্টেটমেন্ট থাকতে হবে — “এই প্রত্যয়ন পত্রটি আমার জানা মতে সত্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রদান করা হলো।”
৭. স্বাক্ষর ও সীল
প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর ও অফিসিয়াল সীল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রত্যয়ন পত্রের উদাহরন
উদাহরণ ১: শিক্ষার্থী প্রত্যয়ন পত্র
XYZ স্কুল অ্যান্ড কলেজ
ধানমণ্ডি, ঢাকা-১২০৫তারিখ: ২৯ জুন ২০২৫
প্রত্যয়ন পত্র
এতদ্বারা প্রত্যয়ন করা যাইতেছে যে, মোঃ জাহিদুল ইসলাম, পিতা: আব্দুল কাইয়ুম, গ্রাম: ফুলবাড়ী, জেলা: দিনাজপুর আমাদের প্রতিষ্ঠানে ২০১৯ সাল হইতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসাবে অধ্যয়নরত ছিলেন।
তিনি এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিয়াছেন এবং তার রোল নম্বর ১০১৫।
এই প্রত্যয়ন পত্রটি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কাজে ব্যবহারের জন্য চাহিয়া লইয়াছেন।
আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষ হিসাবে এই প্রত্যয়ন প্রদান করিলাম।
[স্বাক্ষর]
অধ্যক্ষ
XYZ স্কুল অ্যান্ড কলেজ
সীলসহ
উদাহরণ ২: কর্মচারীর উদ্দেশ্যে
স্বপ্ন কর্পোরেশন লিমিটেড
বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন: ০১৭xxxxxxxx | ইমেইল: contact@bistaritojanun.comতারিখ: ২৯ জুন ২০২৫
এতদ্বারা প্রত্যয়ন করা যাচ্ছে যে,
মোঃ রাশেদুল ইসলাম, পিতা: মোঃ আবদুল করিম,
বর্তমানে আমাদের প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র অ্যাকাউন্ট অফিসার পদে কর্মরত রয়েছেন।তিনি ০১ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে আমাদের প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছেন এবং এখন পর্যন্ত সফলভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তিনি একজন সৎ, কর্মঠ এবং দায়িত্ববান কর্মচারী।
এই প্রত্যয়ন পত্রটি তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহারের জন্য অনুরোধক্রমে প্রদান করা হলো।
এই তথ্যসমূহ আমার জানা মতে সম্পূর্ণ সত্য ও নির্ভরযোগ্য।
ধন্যবাদান্তে,
মোঃ নাজমুল হোসেন
ম্যানেজার (মানবসম্পদ বিভাগ)
স্বপ্ন কর্পোরেশন লিমিটেড০১৮xxxxxxxx
[অফিস সীল]
আরো পরুনঃ
উপসংহার
প্রত্যয়ন পত্র একটি ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ দাপ্তরিক নথি। সঠিক নিয়ম মেনে লেখা একটি প্রত্যয়ন পত্র আপনার কর্মজীবন বা শিক্ষাজীবনের জন্য অনেক দরজার তালা খুলে দিতে পারে। তাই এটি লেখার সময় যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা, তথ্য যাচাই করে উপস্থাপন করা এবং প্রফেশনাল ফরম্যাট বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কোন কিছু বুঝতে সমস্যা হলে দয়া করে কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।